
ভাইরাল বাবার ভালোবাসায় কাঁদছে-হাসছে অনেকে
- আপলোড সময় : ০৩-০৯-২০২৫ ১১:২৬:০৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৩-০৯-২০২৫ ১১:২৬:০৫ পূর্বাহ্ন


নওগাঁ শহরে জুয়েলারি ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদের বাসা। সেখানেই কয়েক দিন ধরে চলছে হইচই। কেউ আসছেন হাতে ফুল নিয়ে, কেউবা ফল। আসছেন সাংবাদিকরাও। কারণ একটাই-ছোট্ট একটি ভিডিও। বাবা ও মেয়ের আবেগঘন সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে নেট দুনিয়ায়।
নূর নাহার, লামিয়া জান্নাত আর মালিহা জান্নাতের বাবা নূর মোহাম্মদ। গত ২৫ আগস্ট মেজ মেয়ে লামিয়া জান্নাত মা-বাবাকে না জানিয়ে ঢাকার বাসা থেকে হঠাৎ নওগাঁ চলে গিয়েছিলেন। দরজা খুলতেই বাবার সামনে দাঁড়ালেন তিনি। বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না নূর মোহাম্মদ। অবাক চোখে মেয়ের মুখে মুখ, কপালে কপাল রেখে যেন ছুঁয়ে দেখলেন-এ কি সত্যি! আলোয় নিয়ে দেখলেন মেয়ের মুখ। আবেগে ভেসে বললেন, বিয়ে দিলে মেয়েরা হারায় যায়। পাশে দাঁড়িয়ে লামিয়ার খুনসুটি, তাহলে কেন বিয়ে দিয়েছিলে? ছোট মেয়ে মালিহা এই মুহূর্তটি ধরে রাখেন মুঠোফোনে ক্যামেরায়। তারপর ফেসবুকে পোস্ট করতেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। কোটি কোটি মানুষ দেখেছেন ভিডিওটি। কেঁদেছেন, হেসেছেন, মুগ্ধ হয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ সন্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ নয় বলে আক্ষেপও করছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, তাদের বাবা কেন নূর মোহাম্মদের মতো হলেন না। সবাই কেন তাকে নিয়ে এত মাতামাতি করছে, তা শুরুতে বুঝতে পারেননি নূর মোহাম্মদ। পরে মেয়েদের কাছ থেকে জানতে পারেন, মেয়ে লামিয়ার সঙ্গে তার একটি ঘরোয়া ছোট্ট ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তার নামের আগে এখন ‘ভাইরাল’ শব্দটাও যোগ হয়েছে। নূর মোহাম্মদের বড় মেয়ে নূর নাহার ও মেজ মেয়ে লামিয়া জান্নাতের শ্বশুরবাড়ি নওগাঁতেই। তারা দুজনই ঢাকায় থাকেন। অনলাইনে ব্যবসা করেন। আর ছোট মেয়ে মালিহা নওগাঁয় স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন, তিনিও অনলাইনে ব্যবসা করেন। এই যুগেও মেয়েদের বিশ্বাস করতে পারি। ওরা খারাপ কিছু করবে না। এই শান্তিটাই বড় শান্তি। ছেলে নেই বলে যে আক্ষেপ ছিল, তা কবেই ভুলে গেছি। মেয়েদের কনফিডেন্স বেড়েছে। মেয়েরা, বিশেষ করে ছোট মেয়েই হয়তো আমার অবর্তমানে আমার ব্যবসার হালও ধরতে পারবে।
এ বিষয়ে লামিয়া জান্নাত বলেন, গত ২৫ আগস্ট মা-বাবাকে না জানিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে তিনি নওগাঁ গিয়ে হাজির হন। বাসায় ঢুকে প্রথমে মা রাকিবা সুলতানাকে চমকে দেন। তখন বাবা নূর মোহাম্মদ বাসায় ছিলেন না। মা ও ছোট বোন মালিহা জান্নাতকে বলে দেন, তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন-এ কথা যেন বাবা আগে থেকে জানতে না পারেন। তারপর বাবা যখন ফেরেন, দরজা খোলেন লামিয়া। চোখের সামনে মেয়েকে দেখে বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মেয়ের কপালের সঙ্গে নিজের কপাল ঘষা দেন, নাকের সঙ্গে নাক ঘষা দেন। আলোয় নিয়ে মেয়েকে দেখেন। তারপর আবেগে বলে ফেলেন, বিয়ে দিলে মেয়েরা হারায় যায়।’ তখন লামিয়াও মজা করে বলতে থাকেন, ‘কেন বিয়ে দিয়েছিলে? মালিহা জান্নাত বলেন, আমাদের এই ভিডিও অনেকে নিজেদের বলে পোস্ট করছেন। বাবাকে তাদের বাবা হিসেবে দাবি করছেন। ঘটনা এমন দাঁড়িয়েছে, অনেকে আমাদেরই ভুয়া মনে করছে। অনেকে বলছে, ভাইরাল হওয়ার জন্যই আমরা এমন ভিডিও করেছি। তবে আমাদের প্রোফাইল ও পেজে গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন-আমরা তিন বোন সব সময়ই বাবাকে নিয়ে নানা পোস্ট দিই, ভিডিও শেয়ার করি। এই ভিডিওটা মানুষ পছন্দ করবে, ভাইরাল করবে, তা তো আর জানতাম না। মা দরজায় বোনকে দেখে অবাক হওয়ার সময়ও ভিডিও করেছিলাম। মা নিজের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না, তাই সেই ভিডিও আমরা শেয়ার দিইনি। গোসল করার পর বাবা আমাদের চুল শুকিয়ে দেন, আঁচড়ে দেন। চুলে তেল, মুখে ক্রিম দিয়ে দেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মশারি টাঙিয়ে দেন, বোতলে পানি ভরে দেন। সকালে জেগেই যেন ফুল দেখি, তাই বাগান থেকে ফুল তুলে মাথার কাছে রাখেন। লামিয়া টেলিফোনে হাসতে হাসতে বলেন, যদি জানতাম এ ভিডিও ভাইরাল হবে, তাহলে বাসার পোশাক পরে নিশ্চয়ই ভিডিও করতাম না, প্রস্তুতি নিয়েই তো করতাম। গত ফেব্রুয়ারিতে লামিয়ার বিয়ে হয়েছে। স্বামী বেসরকারি চাকরিজীবী আবরার মাসুমের সঙ্গে তিনি ঢাকায় থাকেন। বিয়ের পর দুই ঈদে বাবা, মা ও বোনদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এবার লামিয়া নওগাঁ যাবেন, তা শুধু ছোট বোনকে জানিয়েছিলেন। তাই হঠাৎ তাঁদের দেখে মা-বাবা এত অবাক হয়েছিলেন। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে লামিয়া নওগাঁতেই আছেন। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি শুরুতে ভালো লাগলেও এখন আর ভালো লাগছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমার নিজের প্রোফাইলে ভিডিওটির মিলিয়ন ভিউ পার হয়েছে। ভিডিওটি একেকজন নিজেদের মতো করে পোস্ট করছেন, সেখানে কোটি কোটি ভিউ হচ্ছে। অনেকে বাবা ও মেয়ের এ সম্পর্ক দেখে খুশি হয়েছেন। আবার যাদের বাবা নেই বা বাবার আদর পাননি, তাঁরা মন খারাপ করছেন। সব মিলে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। লামিয়া বলেন, বড় বোন নূর নাহারও একইভাবে কাউকে না জানিয়ে ঢাকা থেকে নওগাঁ এসেছেন। মা-বাবা একইভাবে অবাক হয়েছেন। সেই মুহূর্তও ভিডিও করে রাখা হয়েছে। তবে সে ভিডিও আর শেয়ার দেওয়ার কেউ সাহস পাননি বলে জানিয়েছেন তিনি। বাবা ভাবছেন অন্যভাবে—এই এআই প্রযুক্তির যুগে কে কীভাবে ভিডিওটি ব্যবহার করবে, খারাপ কিছু তৈরি হবে কি না, এসব নিয়ে বাবা চিন্তায় আছেন বলেও জানিয়েছেন লামিয়া। গোসল করার পর বাবা আমাদের চুল শুকিয়ে দেন, আঁচড়ে দেন। চুলে তেল, মুখে ক্রিম দিয়ে দেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মশারি টাঙিয়ে দেন, বোতলে পানি ভরে দেন। সকালে জেগেই যেন ফুল দেখি, তাই বাগান থেকে ফুল তুলে মাথার কাছে রাখেন’ বাবার প্রসঙ্গে এভাবেই বলছিলেন লামিয়া। তিনি বলেন, বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে, তবে বাবা কখনো তাদের বকা দেননি। এই দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের মা রাকিবা সুলতানা। সম্প্রতি লামিয়ার স্নাতকের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণে বাবা খুশিতে তিন মেয়ে, এমনকি তাদের মায়ের জন্যও উপহার কিনে এনেছেন। বাবা ও মেয়েদের এমন সম্পর্ক তৈরির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বা সেতুবন্ধের দায়িত্ব পালন করেছেন মা, তাই লামিয়া মায়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নূর মোহাম্মদের সংসারে তিন মেয়ে। ছেলে নেই। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে টেলিফোনে নূর মোহাম্মদের সহজ স্বীকারোক্তি, ছোট মেয়ের জন্মের পর হয়তো একটু আক্ষেপ ছিল। পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এখন জানি, মেয়েরাই আমার ভরসা। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে নূর মোহাম্মদ বলেন, মানুষের মনে বাপ-মেয়ে এভাবে জায়গা করে নেব, তা ভাবতে পারিনি। সেদিন সকালেও মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। মেয়ে কিছুই বলেনি। বাসার দরজা খোলার পর দেখি সেই মেয়ে আমার সামনে। আবেগতাড়িত হই, মেয়েদের একটু বেশি ভালোবাসি তো তাই। মেয়েদের অন্তরে আমি আর আমার অন্তরে আছে মেয়েরা-এমনই সম্পর্ক আমাদের। যাই ঘটুক, মেয়েরা আমার সঙ্গে সব শেয়ার করে। আমিও একই রকম। ভুল করলে মেয়েরা বকাও দেয়। মা-বাবা, পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের বিশাল সংসারে বড় হয়েছেন নূর মোহাম্মদ। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছিল তাঁকে। এখনো মনে করেন, মা-বাবার দোয়ার কারণেই কোথাও আটকে যাননি। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার সুফল পাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেছেন নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, এই যুগেও মেয়েদের বিশ্বাস করতে পারি। ওরা খারাপ কিছু করবে না। এই শান্তিটাই বড় শান্তি। ছেলে নেই বলে যে আক্ষেপ ছিল, তা কবেই ভুলে গেছি। মেয়েদের কনফিডেন্স বেড়েছে। মেয়েরা, বিশেষ করে ছোট মেয়েই হয়তো আমার অবর্তমানে আমার ব্যবসার হালও ধরতে পারবে। নূর মোহাম্মদ বলেন, আমার বাবা বলতেন, সবাইকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। আমিও মেয়েদের একই কথা বলি। আর আমার ভিডিও দেখে অন্য বাবারাও যদি সন্তানদের প্রতি সচেতন হন, সেটাই হবে বড় পাওয়া। অনেক বাবা আমার ভিডিও দেখে আক্ষেপের কথাও জানিয়েছেন, তারা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রেখে ভুল করেছেন। বর্তমান সময়ে সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মা-বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে সন্তান খারাপ কাজ করবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ